গর্ভপাত সমস্যার সমাধা‌নের উপায়

এনটিভির নিয়মিত আয়োজন স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২৮৪১তম পর্বে গর্ভপাত সমস্যা (Abortion Problem) বিষ‌য়ে কথা বলেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. রেজাউল করিম কাজল।

ঝুঁকিপূর্ণ মায়ের গর্ভধারণে সতর্কতা

অনেক সময় গর্ভ ধারণ করার পরও গর্ভপাতজনিত জটিলতার কারণে অনেক মা সন্তান জন্মদানে ব্যর্থ হন। এই মায়েদের ঝুঁকিপূর্ণ মা বলা হয়। পরবর্তীকালে এসব মা সন্তান জন্ম দিতে চাইলে কী ধরনের সতর্কতা নিতে হবে?

প্রশ্ন : ঝুঁকিপূর্ণ মায়েরা গর্ভধারণ করতে গেলে কী কী সতর্কতা অবলম্বন করবেন?
উত্তর : আসলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় যাদের বারবার গর্ভপাতের ইতিহাস রয়েছে, তাদের সাধারণ মানুষ অনেক বেশি পরামর্শ দিয়ে থাকে। বিছানা থেকে নামবেন না, প্রায় এ রকম বিশ্রামের কথা বলে থাকেন। এটা আসলে মূল্যহীন কথা। একজন মা স্বাভাবিক সব কাজকর্ম করবেন।
যদি দেখি, উনি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করেন বা খুবই শারীরিক পরিশ্রম করতে হয় তাঁকে, কিংবা অনেক মানসিক যন্ত্রণা পোহাতে হয়, তাহলে সেই কাজ থেকে আমরা বিরত থাকতে বলি। তবে পরিষ্কারভাবে বলতে চাই, সে স্বাভাবিক নিয়মে তাঁর দৈনন্দিন কাজকর্ম করবে। বিশেষভাবে বিশ্রাম নেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। এটি গেল এক রকম কথা।
আমরা কারণটি খুঁজতে চাই? অনেক সময় দেখা যায় জরায়ুতে যেখানে বাচ্চা থাকবে, বড় হবে সেখানে গঠনগত কোনো ত্রুটি রয়েছে। এটি আল্ট্রাসনোগ্রাফি করে দেখতে পাই। হয়তো জরায়ুর ভেতর যথেষ্ট জায়গা নেই একটি বাচ্চাকে পরিপূর্ণ ভ্রূণে পরিণত করার, সে ক্ষেত্রে তখন অস্ত্রোপচার করে সেই কাজটি ঠিক করা যায়। কিছু কিছু মায়ের ক্ষেত্রে দেখা যায়, কোনো কারণে জরায়ুর মুখ শিথিল হয়ে গেছে। এর আগে হয়তো কখনো ডিএনসি হয়ে থাকতে পারে বা কোনো অস্ত্রোপচার হয়ে থাকতে পারে। তখন যদি আমরা দেখি যে জরায়ুমুখ শিথিল হওয়ার কারণে বাচ্চাটি একটি নির্দিষ্ট সময়ে যাওয়ার পরে সেটা আর জরায়ুতে থাকছে না, বের হয়ে চলে আসছে, তখন আমরা এই কারণটি পেলে জরায়ুমুখকে সেলাই দিয়ে কেটে দিই। ঠিক বাচ্চাটা যখন পরিপূর্ণ হয়, প্রসবের আগে আমরা সেলাইটি কেটে দিই। এটি একধরনের চিকিৎসা।
আর এরপর আমরা প্রতিমুহূর্তে দেখতে থাকি রক্তে সুগার বাড়ছে কি না, মায়ের উচ্চ রক্তচাপ হচ্ছে কি না, কিংবা মায়ের জীবনযাত্রা ঠিক আছে কি না, সঠিক পুষ্টি পাচ্ছেন কি না, কিংবা যদি দেখা যায় দীর্ঘমেয়াদে কোনো সংক্রমণে ভুগছেন, সেই সংক্রমণ প্রতিরোধ করছে কি না। এসব বিষয় খেয়াল করলে একজন মা সফলভাবে একটি সুস্থ শিশু জন্ম দিতে পারেন।
প্রশ্ন : যেসব মায়ের বারবার গর্ভপাত হচ্ছে, তাঁদের বেলায় সন্তান জন্মদানের ঝুঁকি কি একই রকম?
উত্তর : এটা যদি আগের কোনো ইতিহাস থাকে, হয়তো শেষে গিয়ে বাচ্চাটি গর্ভে মারা যায়, হতে পারে সেটা ৩৭ সপ্তাহ কিংবা ৩৮ সপ্তাহ, একেবারে প্রসবের সময়ের কাছাকাছি গিয়ে এ রকম হয়- পরপর যদি এ রকম ঘটনা ঘটে থাকে, সতর্ক হতে হবে। তখন যেটা আমরা করি যেই সপ্তাহে গেলে বাচ্চাটি মারা যায় বা সমস্যা তৈরি হয়, ঠিক তার এক সপ্তাহ আগে বাচ্চাটিকে বের করে ফেলার ব্যবস্থা করি, যেন ওই ঝুঁকিপূর্ণ সময়ে সে আর না যায়।
আর এই বাচ্চাগুলো অবশ্যই হাসপাতালে প্রসব হতে হবে। এমন একটি হাসপাতাল যেখানে জন্মের পরে বাচ্চার যদি কোনো রকম সমস্যা হয়, তার যেন চিকিৎসা করা যায়। সেই সব জায়গাতে গিয়ে বাচ্চাটির জন্ম হওয়া ভালো।

গর্ভপাতের ঝুঁকি কাদের বেশি?

ভ্রুণের সমস্যা বা মায়ের শরীরে বিভিন্ন সমস্যার কারণে অনেক ক্ষেত্রে গর্ভপাতের মতো ঘটনা ঘটে। তবে কারা এ বিষয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ?

প্রশ্ন : কারা এই বিষয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ?
উত্তর : প্রথমে আমরা ঝুঁকি চিন্তা করি। গর্ভধারণের আগেই আমরা মাকে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখতে চাই। আসলে মায়ের শরীরে এমন কী আছে যার জন্য বার বার গর্ভপাত হচ্ছে? প্রথমেই মায়ের বয়স কত সেটি দেখতে হবে। ত্রিশের বেশি বয়সে যারা মা হচ্ছেন, তাদের ক্ষেত্রে গর্ভপাতের আশঙ্কা বেশি। আবার অতি অল্প বয়সের নিচে যাদের বাল্য বিবাহ হচ্ছে যেসব মায়েদের তাদের ক্ষেত্রেও কিন্তু গর্ভপাত হতে পারে বেশি। এরপর যেসব মায়ের ওজন বেশি তাদের ক্ষেত্রে গর্ভপাতের ঝুঁকি থাকে। সে সমস্ত মায়ের অত্যাধিক ওজন তাদেরও আমরা সাবধান করি। বেশি ওজনও তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়াতে পারে। সেই ক্ষেত্রে তার ওজন কমিয়ে তাকে গর্ভধারণ করার জন্য বলি। এগুলো হলো মায়ের শারীরিক বাহ্যিক বৈশিষ্ট্য। এরপর আমরা দেখি সেই মা ডায়াবেটিসে ভুগছেন কি না, উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন কি না, কিংবা তার থাইরয়েড বা হরমোন জনিত কোনো সমস্যা রয়েছে কি না। এগুলো বাংলাদেশে প্রেক্ষাপটে মায়েদের ক্ষেত্রে গর্ভপাতের কারণ।

যেসব কারণে গর্ভপাত হয়

অনেক সময় মা গর্ভধারণ করার পরেও সন্তান জন্ম দিতে ব্যর্থ হন গর্ভপাতজনিত জটিলতার কারণে। বিভিন্ন কারণে এই গর্ভপাতের সমস্যা হয়।

প্রশ্ন : অনেক সময় দেখা যায় মা গর্ভধারণ করছে, তবে তার সন্তানটি জন্মের আগেই মারা যাচ্ছে। এসব সমস্যায় অনেকে ভোগেন। একজন মা গর্ভধারণ করলেন, তবে পেটে সেই সন্তানটি সুস্থভাবে বেড়ে উঠল না বা মা সুস্থ সন্তান জন্ম দিতে পারলেন না। এর কারণ কী?
উত্তর : যেই মায়ের গর্ভে সন্তান আসছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই মা সন্তানের মুখ দেখতে পারছেন না, এই মায়ের মনের কষ্ট আসলে কেউ বোঝে না। যার ব্যথা সেই বোঝে। প্রথম তিন মাস, দ্বিতীয় তিন মাস, তৃতীয় তিন মাস- এই সময় যে বাচ্চাগুলো নষ্ট হয় অথবা পেটে মারা যায়, কিংবা অন্য কোনোভাবে হয়তো পৃথিবীতে আসে না- এগুলো কেন হয়? বৈজ্ঞানিক গবেষণায় এটা দেখা যায় যে প্রথম তিন মাসে যে বাচ্চাগুলো নষ্ট হয় বা গর্ভপাত হয়, সেগুলোর ক্ষেত্রে শতকরা ৭০-৮০ ভাগ ক্ষেত্রে ভ্রূণটিতে সমস্যা থাকে। আর হয়তো ২০ ভাগ ক্ষেত্রে মায়ের শরীরে কোনো সমস্যা থাকে।
আবার যদি বলি ১২ সপ্তাহ থেকে ২৮ সপ্তাহ, দ্বিতীয় তিন মাসে যদি কোনো বাচ্চা নষ্ট হয়, তাহলে আমরা বলি ৫০/৫০। অর্থাৎ শতকরা ৫০ ভাগ ক্ষেত্রে বাচ্চার সমস্যা থাকতে পারে, অথবা ৫০ ভাগ ক্ষেত্রে মায়ের কোনো কারণে হয়তো বাচ্চাটি নষ্ট হচ্ছে।
আবার শেষের দিকে ২৮ সপ্তাহের পরে যদি পেটে বাচ্চা মারা যায়, কিংবা অকালে গর্ভপাত হয়, তাহলে আমরা মনে করি বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সমস্যাটা মায়ের শরীরে ছিল। এভাবে আমরা ভাগ করতে পারি।

গর্ভপাতজনিত সমস্যায় স্বামী-স্ত্রীর রক্তের গ্রুপ দায়ী?
অনেকে মনে করেন স্বামী-স্ত্রীর রক্তের গ্রুপ এক হলে স্ত্রীর ক্ষেত্রে সন্তান ধারণে সমস্যা হয় বা গর্ভপাতজনিত সমস্যা হয়। ধারণাটি কি সঠিক?

প্রশ্ন : স্বামী-স্ত্রীর রক্তের গ্রুপ এক হলে কি স্ত্রীর গর্ভপাতজনিত সমস্যা হয়?
উত্তর : না, সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। স্বামী-স্ত্রীর রক্তের গ্রুপ এক হলে সেটি গর্ভধারণ, কিংবা সন্তান পালন- এসব ক্ষেত্রে কখনোই কোনো খারাপ প্রভাব ফেলে না। তবে কখনো যদি এমন হয় যে স্ত্রীর রক্তের গ্রুপ নেগেটিভ, আর স্বামীর রক্তের গ্রুপ পজিটিভ, তাহলে গর্ভাবস্থায় এবং বাচ্চা জন্মদানের পরে যদি দেখা যায় বাচ্চাটি বাবার রক্তের পজিটিভ গ্রুপ পায়, তখন মাকে একটি বিশেষ ইনজেকশন বা টিকা দিতে হয়। তাতেই সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। কাজেই একই রক্তের গ্রুপ হলে কখনো ক্ষতির কোনো কারণ নেই।

No comments:

Post a Comment