নারীর রজঃস্রাব ও পুরুষের প্রতিক্রিয়া

নারীদেহের একটি সহজ ও সাধারণ জৈবিক প্রক্রিয়া যে কীভাবে বিভিন্ন যুগে, বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন সংস্কৃতি ও ধর্মে এক অসাধারণ প্রতীকী গুরুত্ব পেয়েছে, তা শুধু নৃতত্ত্ববিদদেরই আশ্চর্য করে না, আধুনিক নারীবাদীদের মনেও হতাশা আনে৷
একদিকে ‘ট্যাবু' অর্থাৎ নিষেধ, অন্যদিকে ‘পলিউশন' অর্থাৎ দূষণ, মানবেতিহাসে মেয়েদের মাসিক বা রজঃস্রাবের উপর উভয় দোষারোপই করা হয়েছে৷ মাসিকের রক্তকে বিপজ্জনক ও কলুষিত বলে গণ্য করা হয়েছে৷ অথচ অতীতে এমন অনেক সংস্কৃতি ছিল, যেখানে রজঃস্রাবরত মহিলাদের পবিত্র ও শক্তিশালী বলে গণ্য করা হতো; বলা হতো, তাদের নাকি বিশেষ মানসিক ক্ষমতা আছে, তারা নাকি রোগ সারাতে পারেন৷

চেরোকি ইন্ডিয়ানদের কাছে রজঃস্রাবের রক্ত ছিল নারীর শক্তির উৎস৷ সেই রক্ত শত্রুদের বিনষ্ট করতে পারে, বলে মনে করত চেরোকিরা৷ প্রাচীন রোমে মনে করা হতো, এক রজঃস্রাবরত নারী তার শরীর উন্মুক্ত করলে শিলাবৃষ্টি, ঘূর্ণিঝড় আর বজ্রপাত ভয়ে পালিয়ে যায়৷ এমন এক মহিলা যদি নগ্নদেহে শস্যক্ষেতে হেঁটে বেড়ান, তাহলে পাকা ফসল থেকে পোকা ঝরে যায় – এ কথা লিখেছেন প্লিনি দ্য এল্ডার৷ আফ্রিকায় রজঃস্রাবের রক্ত ছিল একটি অতীব শক্তিশালী জাদুকরি পদার্থ, যা দিয়ে যেমন শুদ্ধ করা যায়, তেমন ধ্বংসও করা যায়৷
ইংরেজি ‘মেন্সট্রুয়েশন' কথাটি ‘মুন' বা চন্দ্র কথাটির সঙ্গে যুক্ত৷ কিন্তু লাতিনে ‘মেনসিস' মানে মাস, যে কথাটি আবার গ্রিক ‘মেনে' বা মুন বা চন্দ্র শব্দ থেকে এসেছে৷ মেয়েদের যে গড়পড়তা ২৯ দিনের মাথায় রজঃস্রাব হয়, তার সঙ্গে চন্দ্রের বাড়া-কমা ও বর্ষপঞ্জীর ৩০ দিনের মাসের সম্পর্ক কোনোকালেই মানুষের চোখ এড়ায়নি৷ কিন্তু রক্তের সঙ্গে দূষণের সম্পর্কটা এই ‘কসমিক হার্মনি'-র বিরুদ্ধে কাজ করেছে৷ রক্ত মাত্রেই দূষিত, সেক্ষেত্রে মেয়েদের শরীর থেকে যে রক্ত নিয়মিত বের হয়ে যায়, তাকে দূষিত বলে ঘোষণা করতে পিতৃতান্ত্রিক সভ্যতার সমাজ ও ধর্মগুরুদের কোনো অসুবিধাই হয়নি৷

মানব ইতিহাসের একটা বড় অংশ পিতৃতান্ত্রিক ধারায় চলে এসেছে৷ কাজেই গোড়ার দিকের খ্রিষ্টানদের কাছে রজঃস্রাবরত মহিলা আর তাদের সঙ্গে সহবাস করে, এমন পুরুষরা ছিল অশুচি৷ এই ধারণা মধ্যযুগ ও তার পরবর্তীকালেও বজায় থাকে৷ ভিক্টোরিয়ান আমলে মেয়েদের রজঃস্রাবকে চিকিৎসাশাস্ত্রের আওতায় আনা হলেও, সেই সঙ্গে যুক্ত হয় অন্যান্য নানা উপসর্গ: রানি ভিক্টোরিয়ার যুগের চিকিৎসকদের কাছে রজঃস্রাব ছিল এক ধরনের অসুখ, যে সময়ে মহিলারা নাকি মানসিকভাবে অযৌক্তিক ও অকর্মণ্য হয়ে পড়েন৷ এই সময় নাকি মহিলাদের দ্বারা কোনো গুরুত্বপূর্ণ মানসিক বা শারীরিক কাজ সম্ভব হয় না, কেননা তারা নির্জীবতা ও হতাশায় ভোগেন৷

হাল আমলে এসে দেখা যাচ্ছে, ‘অসুখ' কথাটা বাদ গেলেও, তার জায়গায় এসে পড়েছে ‘সিনড্রোম' কথাটি, যেমন পিএমএস বা প্রিমেন্সট্রুয়াল সিনড্রোম৷ আর একটি জিনিস রয়ে গেছে: সেটি হলো এই মনোভাব যে, রজঃস্রাব বস্তুটি একটি লজ্জাকর বিষয়, মহিলাদের যা লুকিয়ে রাখা উচিত এবং যে বিষয়ে মহিলাদের পুরুষদের সঙ্গে কথা বলা উচিত নয়৷ বলা বাহুল্য, পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার চাপে অধিকাংশ মহিলাও এই ‘ট্যাবু'-তে পুরুষদের মতোই বিশ্বাসী৷

সমাজতত্ত্বের তাত্ত্বিক এমিল ডার্কহাইম একবার যুক্তি দিয়েছিলেন যে, মানবেতিহাসে ধর্মের উৎপত্তিই নাকি রজঃস্রাব বিষয়টিকে কেন্দ্র করে! ততদূর না গিয়েও আমরা দেখতে পাই যে, প্রতিটি ধর্মেই রজঃস্রাব সংক্রান্ত করণীয়-অকরণীয় নিয়ে চিন্তাভাবনা করা হয়েছে৷ খ্রিষ্টধর্মে লেভিটিকাসের নানা বিধিনিষেধ সত্ত্বেও রজঃস্রাবরত মহিলাদের ‘শুচিতা' নিয়ে আর বিশেষ কোনো বিতর্ক নেই, যদিও মহিলাদের যাজক না হতে পারার একটা প্রচ্ছন্ন কারণ হিসেবে রজঃস্রাবের প্রসঙ্গ বারংবার এসে পড়েছে৷
সে তুলনায় হিন্দুধর্মে প্রথাগতভাবে রজঃস্রাবরত মহিলাদের অশুচি বলে গণ্য করা হয়ে থাকে, এমনকি তাদের রান্নাঘর কিংবা মন্দিরে প্রবেশ করা নিষেধ, অপরাপর পুরুষ বা মহিলাদের স্পর্শ করা নিষেধ৷ ইসলামধর্মে রজঃস্রাবরত মহিলাদের নামাজ না পড়লেও চলে, কাবা প্রদক্ষিণ না করলেও তাদের হজ কার্যকরি হয়৷ স্বামীর সঙ্গে সহবাস ছাড়া সামাজিক জীবনের অন্যান্য সব কাজকর্ম স্বাভাবিকভাবে করতে পারেন রজঃস্রাবরত মহিলারা৷ শিখধর্মে মহিলাদের রজঃস্রাবকে ঈশ্বরপ্রদত্ত একটি জীববিজ্ঞান সংক্রান্ত প্রক্রিয়া বলে গণ্য করা হয়৷
আধুনিকতা নারী-পুরুষের সম্পর্কের অন্য বহু দিক কুসংস্কারমুক্ত করতে পারলেও, মহিলাদের রজঃস্রাব নিয়ে এখনও নারী-পুরুষের মধ্যে প্রকাশ্য ও স্বাভাবিক, এবং সবচেয়ে বড় কথা, আন্তরিক আলাপ-আলোচনা বা আদানপ্রদান হওয়াটা শুধু বিরল নয়, ব্যতিক্রম বলা চলে৷ তা নিয়েই হয়ত আজ কাজ করার সময় এসেছে৷

No comments:

Post a Comment