অবাধ যৌনাচার অনেকটা নেশার মতো হয়ে গিয়েছিল মৌসুমীর। স্বামী-সন্তান থাকার পরও একের পর এক পুরুষের শয্যাসঙ্গী হতে রীতিমতো পাগলপ্রায় ছিলেন। নতুন কারও সঙ্গে পরিচয় হলে অল্পদিনের মধ্যেই তার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক গড়ে তুলতেও ছিলেন সিদ্ধহস্ত। নিষিদ্ধ প্রেমের নেশায় অন্য পুরুষের হাত ধরে চলে যেতেন লং ড্রাইভে। সাভার-নবীনগর এলাকায় গিয়ে নৌকা ভাসাতেন বিস্তীর্ণ জলরাশিতে। অসংখ্য প্রেমিকের মধ্যে বিছানাসঙ্গী করেছিলেন নিজের দুলাভাইকেও। শেষ পর্যন্ত রক্তের হোলিখেলার মধ্যে দিয়ে খতম হতে চলেছে এই লীলাকাহিনীর।
স্ত্রী দিনের পর দিন নিষিদ্ধ প্রেমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছেন তার কিছুই যেন জানতেন না তার ব্যবসায়ী স্বামী জামিল আহমেদ। কিন্তু যখন জানলেন তখন তার সামনে জমদূত হাজির। অবাধ যৌনাচারে বাধা মনে করে তাকে খতমের নীলনকশা প্রস্তুত করে ফেলে মৌসুমী। শেষ পর্যন্ত সেটাই করা হয়। পুলিশের তদন্তে জামিল হত্যার চাঞ্চল্যকর কাহিনী বেরিয়ে এসেছে। সেখানে আছে রোমান্স, আছে রোমহর্ষক নির্মমতা, আছে অবিশ্বাস। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে মৌসুমী খুনের বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন। শুনে আৎকে উঠেছে পুলিশ! নিষিদ্ধ প্রেমের বলি হয়েছে ব্যবসায়ী জামিল আর তার সন্তান হয়েছে পিতৃহারা। মা অপরাধীর কাঠগড়ায়।
ব্যবসায়ী জামিল আহমেদ একমাত্র সন্তানকে নিয়ে সুখেই ছিলেন। যখন জানতে পারেন স্ত্রী মৌসুমী তার দুলাভাই জুয়েলের সঙ্গে পরকীয়ায় মত্ত তখন মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। কলহের সৃষ্টি হয় সংসারে। অন্যদিকে পরকীয়ায় বাধা দূর করতে ৬ মাস আগেই জামিলকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। স্বামী হত্যার এই মিশনে মৌসুমী ও তার ভগ্নিপতি জুয়েলসহ তিনজন অংশ নেয়। ঘটনার পর থেকে মৌসুমীর ভগ্নিপতি জুয়েল, ভাই ইব্রাহিম ও বাবা ইরফান পলাতক রয়েছে। এ ঘটনায় নিহতের বোন সাহিদা পারভীন বাদী হয়ে রাজধানীর চকবাজার থানায় হত্যা মামলা করেছেন।
পুলিশের কাছে হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দিয়েছেন মৌসুমী। জানান, কিলিং মিশন শেষ করতে একটু বেশি সময় লাগে তাদের। কিলিং মিশন শেষ করতে ভোর হয়ে যাওয়ায় ২মে লাশটি সরাতে পারেননি তারা। হত্যার বর্ণনা দিতে গিয়ে মৌসুমী জানিয়েছেন, সন্ধ্যায় ঘুমের ওষুধ দিয়ে যায় জুয়েল। পরিকল্পনামতো রান্না করা গরুর মাংসের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে তা খাওয়ানো হয়। প্রতিদিন রাতে এক গ্লাস দুধ পান করতেন জামিল। দুধেও মেশানো হয় ঘুমের ওষুধ। একইভাবে তা জামিলকে পান করতে দেয় মৌসুমী। গভীর রাতে ফোনে কথা হয় মৌসুমী-জুয়েলের। ফোনে যোগাযোগ করে চকবাজারের ওয়াটার ওয়ার্কস রোডের ওই বাসায় যায় জয়েল ও তার এক সঙ্গী। দরজা খুলে দেয় মৌসুমী নিজেই। জুয়েল ও ওই সঙ্গীর হাতে ছিল ধারালো অস্ত্র, প্লাস্টিকের বস্তা ও দড়ি। হত্যা ও হত্যার পর লাশ সরানোর প্রস্তুতি নিয়ে এসেছিল তারা। ঘুমের মধ্যেই মুখ চেপে ধরা হয় জামিলের। ঘুম ভেঙে যায় তার। শুরু হয় ধস্তাধস্তি। কিন্তু বিছানা থেকে ওঠার সুযোগ দেওয়া হয়নি জামিলকে। ওঠার চেষ্টা করতেই তাকে বঁটি দিয়ে এলোপাতাড়িভাবে কোপানো হয়। জামিল চিৎকার করার চেষ্টা করলে মুখে স্কসটেপ লাগিয়ে দেয় মৌসুমী। ধারালো অস্ত্র দিয়ে কাটা হয় গলা। কিলিং মিশন শেষ করতে ভোর হয়ে গেলে বস্তাবন্দি করে প্রথমে আলমারিতে ঢোকানোর চেষ্টা করা হয় লাশ। পরে বস্তাবন্দি লাশটি ফেলে রাখা হয় খাটের নিচে। মৌসুমীর হাতে-মুখে-গায়ে তখন স্বামীর রক্ত। তার প্রেমিক জুয়েল ও সঙ্গী লোকটি চলে যাওয়ার পর জামা খুলে রাখে সে। পানি ও ছাই দিয়ে রক্তাক্ত মেঝে পরিষ্কার করে।
হত্যার কারণ সম্পর্কে মৌসুমী জানিয়েছে, ৬ মাস আগে ভগ্নিপতি জুয়েল ও মৌসুমীকে অন্তরঙ্গ অবস্থায় দেখে সন্দেহ করেছিল জামিল। এ নিয়ে জুয়েলের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি হয় জামিলের। তবু স্বামীর অগোচরে জুয়েল ওই বাসায় যাওয়া-আসা করত। এ নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কলহ বাড়তে থাকে। ছয় মাস আগে জামিলকে হত্যার পরিকল্পনা করে জুয়েল ও মৌসুমী। তারা মনে করত জুয়েলকে হত্যা করলে তাদের প্রেমে কোনো বাধা থাকবে না। অন্যদিকে তার সম্পত্তিও ভোগ করতে পারবে তারা। চকবাজার থানার ওয়াটার ওয়ার্কস রোডের জামিল ও মৌসুমীর বাসার পাশেই স্ত্রী-সন্তান নিয়ে থাকেন জুয়েল। জামিল বাসায় না থাকলেই মৌসুমীর বাসায় ছুটে যেত জুয়েল। কখনো কখনো মৌসুমীকে অন্যত্র নিয়ে যেত সে।
স্বামীকে হত্যার পর ঘটনা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে মৌসুমী দুপুরে জামিলের বোন সাহিদাকে ফোনে বলে, ”বাজি (বোন) আপনার ভাইকে পাওয়া যাচ্ছে না। ফজরের নামাজ পড়ে বের হইছে মাল (পণ্য) নামাতে।” মৌসুমী জানতে চায় জামিল তার বাসায় গিয়েছে কি-না। এমনকি ছিনতাইকারীদের কবলে পড়েছেন বলে শঙ্কা প্রকাশ করে। সাহিদা পরামর্শ দেন থানায় জিডি করতে। তাতে অনীহা প্রকাশ করে মৌসুমী।
সাহিদার মেয়ে রুমা জানান, বেলা ২টার দিকে তিনি ফোন দিয়ে মামা জামিলের খোঁজ নেন। বাসায় আসার আগ্রহ দেখালে বাধা দেন মৌসুমী। বরং নিজেই চলে যান মোহাম্মদপুরে সাহিদার বাসায়। একইভাবে স্কসটেপ কারখানার মালিক জামিলকে সকালে কারখানায় না পেয়ে তার ফোনে যোগাযোগ করেন কারখানার ম্যানেজার রাসেদ। ফোন বন্ধ পেয়ে এক কিশোরকে বাসায় পাঠালে তাকে বাসায় ঢুকতে না দিয়ে তাড়াহুড়া করে বিদায় করে দেয় মৌসুমী। রাসেদ জানতেন দীর্ঘদিন থেকে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কলহে চলছে। এতে সন্দেহ সৃষ্টি হয় তার। এক পর্যায়ে রাত ৮টায় থানায় জিডি করতে যান কারখানার ম্যানেজার ও কর্মচারীরা। সঙ্গে ছিলেন জামিলের ব্যবসায়িক বন্ধু আল-আমিন ও আসলাম। ওই সময়ে জামিলের বোন সাহিদাও ছুটে যান থানায়। পরে পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে দরজা খুলতে গেলে নাটকীয়তা শুরু করে মৌসুমী। মৌসুমী জানায়, চাবি হারিয়ে ফেলেছে।
চকবাজার থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোরাদুল ইসলাম জানান, দরজার তালা ভাঙতেই ভেতর থেকে গন্ধ পাওয়া যায়। বেডরুমে খাটের নিচে পাওয়া যায় জামিলের লাশ। এ সময় মৌসুমী পুলিশকে জানায় রবিবার রাত ১২টার দিকে আসলাম ও আল আমিন জামিলকে বঁটি দিয়ে গলা কেটে খুন করে। এ সময় মৌসুমী, আল-আমিন ও আসলামকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, আল-আমিনের সঙ্গে কয়েক মাস আগেও পরকীয়ার সম্পর্ক ছিল মৌসুমীর। নিজের বর্তমান প্রেমিক ভগ্নিপতি জুয়েলসহ প্রকৃত খুনিদের আড়াল করতে পূর্বের প্রেমিক ও তার সঙ্গী বন্ধুকে ফাঁসাতে চেয়েছিল মৌসুমী। শেষ পর্যন্ত বিষয়টি স্বীকার করেছে মৌসুমী নিজেই। এর সত্যতা স্বীকার করছেন তদন্তকারী কর্মকর্তা পরিদর্শক মোরাদুল ইসলাম। তবু মৌসুমীর এসব বক্তব্য যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। এ ঘটনায় জুয়েল জড়িত থাকলে তার সঙ্গে কে ছিলেন তা জানার চেষ্টা করা হচ্ছে। এজন্য গতকাল পাঁচ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে মৌসুমীকে। এছাড়াও আল-আমিন এবং আসলামকে দু’দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে।
জামিলের বোন সাহিদা জানান, সোয়ারীঘাটে জামিলের স্কসটেপের কারখানা। এছাড়াও চকবাজার ও ইসলামবাগে তার দুটি পাইকারি দোকান আছে। এসব দখল করার জন্যই মৌসুমী ও তার ভগ্নিপতি, শ্বশুর-শাশুড়ি এবং শ্যালক মিলে তাকে হত্যা করেছে। মৌসুমী গ্রেফতার হলেও ঘটনার পর থেকে অন্যরা পলাতক রয়েছে। জামিলের পিতার নাম শফি আহমেদ। তারা পাঁচ বোন ও তিন ভাই। জামিল ও সাহিদা ছাড়া সবাই থাকেন ভারতের বিহারে। প্রায় সাত বছর আগে মৌসুমীর সঙ্গে পরিচয় ও বন্ধুত্ব হয় জামিলের। পরে বিয়ে হয় তাদের। চকবাজার ওয়াটার ওয়ার্কস রোডের মসজিদ গলির মোহাম্মদ ইরফানের মেয়ে মৌসুমী। তার বড় বোন মুন্নীর স্বামী একই এলাকার বাসিন্দা আশরাফ উদ্দিনের ছেলে জুয়েল।
No comments:
Post a Comment