নারী‌দের মে‌নোপজ ও করণীয়

মেনোপজ নারীদের একটি শরীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া। সাধারণত ৪৫ থেকে ৫০ বছর বয়সে এই বিষয়টি হয়।

মেনোপজ কী বা মেনোপজের কারণ কী?

মেনোপজ বলতে গেলে আগে বুঝতে হবে ঋতুস্রাব কী জিনিস? ১৩/ ১৪ বছর বয়স থেকে আপনার ৪৫ থেকে ৫০ বছর পর্যন্ত, প্রতি মাসে মেয়েদের শরীর থেকে যে রক্তটা ঝড়ে যাচ্ছে, একে আমরা ঋতুস্রাব বলছি। এর সঙ্গে অবশ্যই হরমোনের একটি বিষয় থাকে। আর ঋতুস্রাব না হওয়াটাই হলো মেনোপজ। তবে এর জন্য একটি সময় থাকে। ৪৫ বছরের পরে ৫০ এর কাছকাছি সময়ে যদি কোনো মায়ের এক বছর সমপরিমাণ সময়ে ঋতুস্রাব বন্ধ থাকে, সেই ক্ষেত্রে আমরা বলতে পারি এই মায়ের মেনোপজ হয়ে যাচ্ছে।
মেনোপজের কারণ হিসেবে বলা যায়, ডিম্বাশয়ে যে ফলিকলগুলো থাকে, এগুলো কমে যাওয়ার কারণেই আসলে হরমোনাল সাপোর্ট (হরমোনের সহযোগিতা) থাকে না। এই কারণে মেনোপজের দিকে চলে যাচ্ছে। ঋতুস্রাব বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।

মেনোপজ শরীর ও মনে প্রভাব ফেলে

দীর্ঘমেয়াদে ঋতুস্রাব বন্ধ হওয়ার প্রক্রিয়াকে মেনোপজ বলে। ৪৫ থেকে ৫০ বছর বয়সে সাধারণত নারী শরীরে এই পরিবর্তন হয়। মেনোপজ শরীর ও মনে বড় ধরনের প্রভাব ফেলে।
মেনোপজ নারীদের ক্ষেত্রে একটি বড় ধরনের পরিবর্তন আনে। প্রভাবের কারণ, সম্পূর্ণ বিষয়টি হলো হরমোনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। একটি রিপ্রোডাকটিভ এইজের (প্রজনন বয়স) মেয়ের রূপ, গুণ, চাকচিক্য সবকিছু হরমোনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এই হরমোন যখন শরীর থেকে হঠাৎ চলে যায় অথবা ধীরে ধীরে চলে যাওয়ার সময় হয়, তখন শরীরে আসলে ব্যাপক পরিবর্তন হয়। দেখা যায় যে মেজাজ খিঁটখিঁটে হয়ে যায়। কোনো কিছু ভালো লাগে না। হঠাৎ করে কান মাথা গরম হয়ে যায়। রোগীর অভিযোগ থাকে, হাতের তালু জ্বলে, পায়ের তালু জ্বলে, চিকন ঘাম হয়।

এসব লক্ষণগুলো মেনোপজ হওয়ার আগে থেকে শুরু হতে পারে।
মেনোপজের আগে একটি সময় থাকে, যাকে আমরা বলি পেরিমেনোপজাল পিরিয়ড। মেনোপজাল ট্রানজিশন। মানে আস্তে আস্তে ঋতুস্রাব কমে যাচ্ছে। আগে যেটি মাসে মাসে হতো সেটি দুই মাস তিন মাস পরে হচ্ছে। অথবা অনিয়মিত হচ্ছে বা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। এই সময় থেকে শরীরের এই পরিবর্তনগুলো শুরু হয়। শেষ পর্যন্ত যখন ঋতুস্রাব পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়, ডিম্বাশয় থেকে যখন হরমোন আসে না, ফলিকলের সহযোগিতা থাকে না, তখন লক্ষণগুলো অনেক বেশি দেখা দেয়। এর মধ্যে আরো পরে ইরিটিবিলিটি সিনড্রম থাকে, জেনিটিইউরিনারি সিনড্রম থাকে-এগুলো পরে দেখা যায়।

জেনেটিইউরিনারি সিনড্রম

জেনেটিইউরিনারি সিনড্রম বলতে বোঝা যাচ্ছে যে, ইউরিনে সমস্যা হচ্ছে। দেখা যায় যে খুব ঘন ঘন প্রস্রাবের সমস্যা হতে পারে। অথবা প্রস্রাব ঠিকমতো হচ্ছে না, এটি হতে পারে। হাঁচি কাশির সঙ্গে প্রস্রাব ঝড়ে যাচ্ছে, এমন হতে পারে। অথবা রোগীরা অনেক সময় আমাদের কাছে এসে বলে যে, ‘শরীর শুকনো লাগে’। ভ্যাজাইনাল ড্রাইনেস হয়। এতে তাদের দাম্পত্য জীবন ব্যহত হয়। এ ধরনের অনেক সমস্যা নিয়ে রোগীরা আমাদের কাছে এসে থাকে।
মেন্টাল ইরিটেশন থাকে। বিরক্তি থাকে। দেখা যায়, ছেলেমেয়ের হয়তো অভিযোগ থাকে, ‘মাকে কিছু বললেই মা রেগে যায়।’ স্বামীর অভিযোগ থাকে, ‘বউকে কিছু বলাই যায় না, রেগে যায়।’ সবচেয়ে বড় বিষয় হলো যেহেতু হট ফ্লাস হয়, তাই ঘরে স্বামী স্ত্রীর মধ্যে একজন হয়তো ফ্যান ছাড়ছে, এসি ছাড়ছে। আর স্বামীর হয়তো শীত লাগছে। সে এসি বন্ধ করতে বলছে। এ নিয়ে মনোমালিন্য হয়। তখন দেখা যায় যে মানসিক দ্বন্দ্ব শুরু হয়ে যায়। আর সন্তানদের সঙ্গে এই সময়ে কেন যেন একটু মানসিক দূরত্বও হয়ে যায়। কারণ, যেহেতু একটু বিরক্তি কাজ করে, অল্প কথাতেই রাগ হয়ে যায়, কান্না পায়, অস্থিরতা করে- তাই ছেলেমেয়েরাও একটু দূরে চলে যায়। মানসিক সহযোগিতাটা এই সময় সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।

মেনোপজ হ‌লে করণীয়

মেনোপজের ( দীর্ঘমেয়াদে ঋতুস্রাব বন্ধ) সময় হট ফ্লাস হওয়া, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়াসহ বিভিন্ন শারীরিক ও মানসিক সমস্যা হয়। তাই এ সময়ের কিছু করণীয় দিক আ‌ছে। বি‌শেষ ক‌রে ডাক্তা‌রের পরামর্শ গ্রহন।
প্রথমত আমরা ডাক্তাররা রোগীকে বলি, এটি আপনার হবে। স্বাভাবিক। আপনার বয়স অনুযায়ী ঋতুস্রাব যেমন শুরু হয়েছিল, খুব অল্প বয়সে, তখনো কিন্তু এটা মেনে নিতে একটু সময় লেগেছে, এখন আপনার বয়স হয়ে গেছে, এখন ঋতুস্রাবটা বন্ধ হয়ে যাবে। আর আপনি শরীরে যে পরিবর্তনগুলো লক্ষ করছেন সেগুলো ঋতুস্রাব বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণেই হচ্ছে। একটি সময় জিনিসগুলো আরেকটু বাড়বে, যখন একদমই হরমোন থাকবে না। তবে ভয় পাবেন না। উপসর্গগুলো যেন কম থাকে আপনার, সেই জন্য আমরা আপনাকে বলে দেব, কীভাবে আপনার খাওয়া উচিত, কী অভ্যাসে আপনাকে অভ্যস্ত হতে হবে। চাইলে এসব রোগীর এইচআরটির পরামর্শও দিয়ে থাকতে পারি।

কখন এইচআরটির পরামর্শ দেয়া হয়?

উন্নত বিশ্বে এইচআরটি তো খুব প্রচলিত। এইচআরটি হলো হরমোন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি। মানে যে হরমোনগুলো না থাকার কারণে শরীরের যে পরিবর্তনগুলো আসছে, আমরা বাইরে থেকে হরমোন সাপ্লিমেন্ট দিয়ে এই উপসর্গগুলো কিছুটা কমিয়ে রাখার চেষ্টা করি। স্বাভাবিকভাবে হয়তো যেরকম থাকার কথা সেরকম করা যায় না। আমরা অতটা উচ্চ ডোজে না দিলেও এইচআরটি মধ্যমমানের দেওয়া যায়।

সবার জন্যই কি এইচআরটি প্রযোজ্য?
রোগী নির্বাচনের বিষয় থাকে। যদি কারো কার্ডিওভাসকুলার ঝুঁকি থাকে, হার্টের রোগ থাকে, হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি থাকে, কেউ স্থূল হয়, কিংবা যদি তার প্রেশার থাকে, যেকোনো ঝুঁকি যদি থাকে, সেই ক্ষেত্রে আমরা এইচআরটি পছন্দ করি না। তবে যদি কারো এই সমস্যাগুলো না থাকে তাহলে আধুনিক যুগে বলা হয় এইচআরটি আসলে অধিকারের মতো। এতদিন যে আমরা বলে আসতাম, এইচআরটি নিলে ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ে, এইটা আসলে এখন আর মানতে চাচ্ছে না কেউ। বলা হচ্ছে যে ঝুঁকি যাদের থাকে, তাদের আমরা দেব না। তবে যাঁর ঝুঁকি নেই তাকে আসলে এইচআরটি থেকে বঞ্চিত করা ঠিক নয়।

মেনোপজের সময় প্রতিদিন ৩০ থেকে ৪৫ মিনিট হাঁটুন

মেনোপজের সময় অবসাদের কারণে অনেকে ব্যায়াম করতে চান না। তবে এ সময় ব্যায়াম করা জরুরি। এই সময়ে মানসিক অবসাদ থেকে অনেক সময় এমন হয়। তবে অন্তত পক্ষে ৩০ থেকে ৪৫ মিনিট হাঁটা উচিত এবং জয়েন্ট মুভিং এক্সারসাইজ করা উচিত। কারণ, এ সময় শরীরে ক্যালসিয়ামের ঘাটতি বেশি থাকে।
দেখা যায়, ছোটবেলা থেকে মেয়েদের ক্ষেত্রে অপুষ্টির বিষয়টি থাকে। এটি আমাদের দেশের এখনো সাধারণ জনগণের মধ্যে হচ্ছে। এই মেয়েটি যখন বড় হচ্ছে তখন তার ঋতুস্রাব শুরু হচ্ছে। অপুষ্টি থাকাকালীন ঋতুস্রাব হচ্ছে। তার আরো ঘাটতি হচ্ছে। এর পরে একটি সময়ে সে গর্ভধারণ করছে। এ সময়ও শরীরে অনেক পরিবর্তন হয়। ধাপে ধাপে তার পুষ্টির ঘাটতি আছে। এমন একটি পর্যায় নিয়ে যখন সে শেষ পর্যন্ত মেনোপজে চলে যায়, তখন তার হাড় তৈরি হওয়ার চেয়ে ক্ষয় হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়। এসব বিষয় মাথায় রাখতে হবে। তাকে ক্যালসিয়াম সাপ্লিমেন্ট দিতে হবে। বলতে হবে, আপনি ক্যালসিয়ামযুক্ত খাবার খাবেন। প্রয়োজনে পুষ্টিবিদের সাহায্য নিতে পারেন। দুধ ও দুগ্ধ জাতীয় খাবার তাকে বেশি খেতে হবে। শারীরিক ও মানসিকভাবে তাকে শক্তিশালী হতে হবে এই সময়।

মেনোপজের সময় খাদ্যাভ্যাস যেমন হবে

মেনোপজের (দীর্ঘমেয়াদে ঋতুস্রাব বন্ধ হওয়া) সময় যেহেতু শরীরে একটি বড় প্রভাব পড়ে তাই খাদ্যাভ্যাসে কিছু বিষয় খেয়াল রাখা প্রয়োজন।
ঋতুস্রাব হওয়া আমাদের দেশের মানুষের জন্য অনেক বড় একটি ব্যাপার। ঋতুস্রাব বন্ধ হয়ে যাওয়া মানেই যেন ‘আমি বুড়ো হয়ে গেছি’। তবে বাইরের দেশ তো এ রকম নয়। বাইরের দেশের মানুষ ৭০/ ৮০ বছর বয়স পর্যন্ত অনেক সক্রিয় থাকছে। আমাদের দেশের অবস্থা অনুযায়ী বিষয়টি এ রকম নয়। এখন হতে পারে আমাদের সংস্কৃতিক কারণ, ধর্মীয় কারণ, অনেক কিছুর জন্য আমরা এ রকমভাবে তৈরি। তখন আসলে আমাদের পরামর্শ দিতে হবে, কীভাবে চলা উচিত, কী কী জিনিস এড়িয়ে যাওয়া উচিত।
যেমন, একজন তরুণের শক্তি তৈরির প্রয়োজন বেশি হয়। খাদ্যাভ্যাসও সেই রকম হতে হবে। শর্করা খেতে হবে, আমিষ খেতে হবে, চর্বিযুক্ত খাবার খেতে হবে। তবে একজন মা যার ঋতুস্রাব বন্ধ হয়ে গেছে, তার আসলে এত ভারী কাজের তো কিছু নেই। তখন খাদ্যাভ্যাসকে পরিবর্তন করে দিতে হবে। আমাদের এভাবে খাদ্যতালিকা তৈরি করে দিতে হবে যে তার ৪০ ভাগ থাকবে কার্বোহাইড্রেট, আর ১৫ ভাগ থাকবে আমিষ, বাকি ৪০ ভাগ পরিবর্তিত হবে সবজি ও ফল দিয়ে। সবজি ও ফলের ওপর খুব বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ, মাইক্রোনিউট্রিয়েন্স খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মাইক্রোনিউট্রিয়েন্স বলতে আমরা সাধারণত বুঝি ভিটামিন, ক্যালসিয়াম, আয়রন সাপ্লিমেন্ট এগুলো। দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার এই সময় বেশি খেতে হবে।

ডা. নাঈমা শারমিন হক
সহকারী অধ্যাপক, অবসটেট্রিক্স অ্যান্ড গাইনোকোলজি বিভাগ,
জয়নুল হক সিকদার ওমেন্স মেডিকেল কলেজ।

No comments:

Post a Comment