গর্ভকালীন খিঁচুনিকে জিন-ভূতের আছর মনে করা মোটেই ঠিক নয়—এটি একটি কুসংস্কার, ভ্রান্ত ধারণা। আমাদের দেশে গর্ভবর্তী নারীরা অনেক সমস্যার মুখোমুখি হন। এ সমস্যার অন্যতম কারণ হচ্ছে, গর্ভবতী নারীকে নিয়ে নানা কুসংস্কার। গর্ভবতী নারীর পুষ্টি, পরিচর্যা, এমনকি গর্ভাবস্থার অসুস্থতা নিয়েও কুসংস্কার রয়েছে। এই কুসংস্কারের কারণে গর্ভবতী ও গর্ভস্থ শিশু উভয়ের জীবনই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে।
গর্ভাবস্থায় সবচেয়ে মারাত্মক ও ঝুঁকিপূর্ণ স্বাস্থ্য সমস্যার নাম অ্যাকলামশিয়া। এ সমস্যার শুরুতে রোগীর শরীরে পানি আসে, পা ফুলে যায়, বমি হয়, প্রস্রাবে অ্যালবুমিন বেশি বের হয়, রক্তচাপ বেড়ে যায় এবং তীব্রতম পর্যায়ে খিঁচুনি শুরু হয়। উল্লিখিত লক্ষণ ও উপসর্গের সঙ্গে আরো কিছু লক্ষণ উপসর্গ মিলে গর্ভবতীর অবস্থা তখন আশঙ্কাজনক পর্যায়ে পৌঁছে যায়। মৃত্যুর সঙ্গে প্রাণপণ লড়াই করতে করতে একসময় তাকে হয়তো ইহধাম ত্যাগ করতে হয়।
দুঃখজনক হলেও সত্যি, অ্যাকলামশিয়াকে আমাদের দেশের কুসংস্কারাচ্ছন্ন লোকজন জিন-ভূতের আছর কিংবা খারাপ বাতাস লাগা বলে মনে করে।
অ্যাকলামশিয়ার জন্য যেখানে রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করে উচ্চতর চিকিৎসা করা প্রয়োজন, সেখানে কুসংস্কারাচ্ছন্ন হয়ে লোকজন রোগীকে নানা ঝাড়ফুঁক, পানিপড়া ও তন্ত্রমন্ত্র দিয়ে জীবনকে বিপন্ন করে তোলে। অথচ গর্ভাবস্থায় একটু সতর্ক ও সচেতন হলেই এ মারাত্মক বিপর্যয় থেকে সন্তানসম্ভবা নারীকে রক্ষা করা যায়। গর্ভাবস্থায় নিয়মিত প্রসবপূর্ব চেকআপ ও যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে অ্যাকলামশিয়া থেকে মুক্ত থাকা সম্ভব।
গর্ভাবস্থায় মায়ের প্রতি অযত্ন ও অ্যান্টিনেটাল বা প্রসবপূর্ব চেকআপ সম্পর্কে অসচেতন হওয়ার কারণেই অ্যাকলামশিয়ার মতো মারাত্মক স্বাস্থ্য সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। অথচ লোকজন অ্যাকলামশিয়ার অন্যতম উপসর্গ খিঁচুনি ও প্রলাপ বকা দেখে একে অশরীরী আছর বলে মনে করে। চিকিৎসার পরিবর্তে ঝাড়ফুঁকের নির্মম অত্যাচার করা হয়। পরিণতিতে একজন গর্ভবতীর মৃত্যুর বিনিময়েও মাতৃত্বের স্বাদ থেকে বঞ্চিত হয়। যে মাতৃত্ব হতে পারত আনন্দের, সে মাতৃত্ব তাকে ঠেলে দেয় করুণ পরিণতির দিকে। কাজেই অ্যাকলামশিয়ার ঝুঁকি এড়াতে গর্ভসঞ্চারের আগে থেকেই চিকিৎসকের তত্ত্বাবধায়নে থেকে ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। কোনোরকম অসুস্থতা দেখার আগেই গর্ভবতী এ ব্যবস্থা নেবেন। আর খিঁচুনি দেখা দিলে কিংবা মুখ দিয়ে ফেনা বের হলে, গর্ভবতী অজ্ঞান হলে, প্রলাপ বকলে ঝাড়ফুঁক না করে রোগীকে ডাক্তারের কাছে কিংবা ধারের কাছের হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। মনে রাখবেন, গর্ভাবস্থায় খিঁচুনি কোনোরকম খারাপ বাতাস লাগার কারণে হয় না। গর্ভাবস্থায় রক্তচাপ বেড়ে গিয়ে সেটি মস্তিষ্কেও প্রভাব ফেলে। পরিণামে মস্তিষ্কে পানি জমে এবং খিঁচুনি হয়। সময়মতো চিকিৎসা করালে এই খিঁচুনি দূর করা কোনো কঠিন ব্যাপার নয়।
ডা. সজল আশফাক
সহকারী অধ্যাপক হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজ।
No comments:
Post a Comment