জরায়ুমুখ ক্যান্সার : সচেতনতা জরুরি
স্তন ক্যান্সারের পর নারীরা সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয় জরায়ুমুখের ক্যান্সারে। জরায়ুমুখ ক্যান্সার বা জরায়ুর ক্যান্সার (ইংরেজি : Cervical cancer) নারীদের জন্য একটি ভয়াবহ ব্যাধি এবং জরায়ুমুখ ক্যান্সার বিশ্বব্যাপী নারীদের মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ। বিশ্বে প্রতি দুই মিনিটে একজন নারী জরায়ুমুখ ক্যান্সারে মৃত্যুবরণ করেন এবং প্রতি বছর ৫০ লক্ষাধিক নারী নতুন করে আক্রান্ত হন।
জরায়ুমুখ ক্যান্সার ১৫-৪৫ বছর বয়সের নারীদের মধ্যে বেশি দেখা যায়, কিন্তু ক্যান্সারের লক্ষণ প্রকাশের প্রায় ২ থেকে ২০ বছর আগেই একজন নারী এ রোগের ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হন। তবে সচেতনতার মাধ্যমে এই রোগ প্রতিরোধ করা যায়। সাধারণত অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের নারীরা স্বাস্থ্য বিষয়ে সম্পূর্ণ সচেতন না বলে এই রোগের বিস্তার বেশি। তবে উন্নত দেশের নারীরা এ বিষয়ে সচেতন এবং উন্নত জীবনযাপনের কারণে অনেকটাই এই রোগ থেকে নিরাপদ। জরায়ু-মুখ ক্যান্সার শনাক্ত করার জন্য ‘পেপস স্মেয়ার টেস্ট’ রয়েছে, যা অত্যন্ত কার্যকর।
বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ১৩,০০০ নারী নতুন করে জরায়ুমুখ ক্যান্সারে আক্রান্ত হন এবং প্রতিবছর মৃত্যুবরণ করেন প্রায় ৬,৬০০ নারী। অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে সারাদেশে ১৮ জন নারী মারা যাচ্ছেন জরায়ু-মুখ ক্যান্সারে। জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের ক্যান্সার ইপিডেমিওলজি বিভাগ থেকে সর্বশেষ প্রকাশ করা প্রতিবেদন মতে, ২০০৫ সালে পাঁচ হাজার ৪১১ জন মোট ক্যান্সার শনাক্ত রোগীর মধ্যে নারীর সংখ্যা ছিল দুই হাজার ২৭৫ জন। এর মধ্যে জরায়ুমুখের ক্যান্সারের রোগীর সংখ্যা ছিল ৫৬১ জন। এ ক্যান্সারে আক্রান্ত ৫৬১ জনের মধ্যে ২১৩ জনেরই বয়স ছিল ৪০ থেকে ৪৯ বছর বয়সের মধ্যে। আর ২০ থেকে ২৯ বছর বয়সের মধ্যে ছিল ২৬ জন।
জরায়ুমুখ ক্যান্সার প্রতিরোধক টিকা
সাধারণত ১০ বছর বয়সের পর থেকেই জরায়ুমুখ ক্যান্সার প্রতিরোধক টিকা নেয়া যায়। মোট তিন ডোজ টিকা নিতে হয়; প্রথম ডোজের এক মাস পর দ্বিতীয় ডোজ এবং প্রথম ডোজের ছয় মাস পর তৃতীয় ডোজ টিকা নিতে হয়। টিকা গ্রহণের পাশাপাশি নিয়মিত পরীক্ষা করালে জরায়ুমুখ ক্যান্সারের আক্রমণ হার কমিয়ে আনা যায়। ভাইরাস এইচপিভি-১৬, এইচপিভি-১৮, এইচপিভি-৬, এইচপিভি-১১-এর প্রতিরোধক টিকা আবিষ্কৃত হয়েছে। আমেরিকার ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ) নিয়মানুযায়ী নয় থেকে ২৫ বছর বয়সে এ টিকা কার্যকর হয়। গর্ভাবস্থায় এ টিকা প্রদানের অনুমোদন নেই। আক্রান্ত হয়ে ক্যান্সার সংঘটনের পর এই টিকা আর কোনো কাজে আসে না।
তবে ঔষধি প্রতিরোধকের চেয়ে আচরণগত প্রতিরোধকের দিকে বিজ্ঞানীরা বেশি গুরুত্বারোপ করেছেন। যেমন: বাল্য বিবাহ রোধ; অধিক সন্তান প্রসব; ধুমপান করা (এমনকি পরোক্ষ ধূমপানের স্বীকার হওয়া); পানের সাথে জর্দা, সাদা পাতা, দাঁতের গোড়ায় গুল (তামাকের গুঁড়া) রাখা ইত্যাদি কারণে এই ক্যান্সারে আক্রান্তের সম্ভাবনা বাড়ে। আর সুষম খাবার গ্রহণ; দৈনিক তিন-চারবার ফল, শাকসব্জি, তরকারি খাওয়া; পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, স্বাস্থ্যসম্মত, সুশৃঙ্খল জীবনযাপন, সামাজিক ও ধর্মীয় অনুশাসন মান্য করা এই রোগ প্রতিরোধে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। এর পাশাপাশি নারীর, নিয়মিত পেপস স্মেয়ার টেস্টে অংশ নেওয়া উচিত, তাতে রোগ আগেভাগে সনাক্ত করা সম্ভব হয়।
জরায়ুমুখের ক্যান্সারের সমস্যা কখনই পুষে রাখা যাবে না। তাছাড়া এ ধরনের সমস্যা প্রতিরোধ করতে সচেতনতা জরুরি। তবে শুধু অসুবিধা হলেই যে রোগী আসবে সেটি নয়, যেকোনো নারীর সবারই এ পরীক্ষা করা উচিত। সমস্যা ছাড়াও এটি করা যায়। আর পরীক্ষা করলে যে কারো সমস্যা ধরা পড়বে, সেটিও নয়।
জরায়ুমুখ ক্যানসার প্রতিরোধে ভ্যাকসিন দেওয়া হয়। নয় বছর বয়স থেকে এই ভ্যাকসিন দেওয়া যেতে পারে। এর তিনটি ডোজ আছে। ১৪ বছরের আগে দুটো ডোজের কথা বলা হয়। ১৪ বছরের পর যাদের বয়স, তাদের তিনটা ডোজ দেওয়া হয়। ৩০ বছর পর্যন্ত এই সংক্রমণ হতে পারে। এরপর ধীরে ধীরে হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাসের হারটা কমে আসে।
জরায়ুমুখ ক্যানসার: আগেভাগেই ঠেকানো সম্ভব
জরায়ুমুখ ক্যানসার বিশ্বব্যাপী নারী-মৃত্যুর অন্যতম কারণ। পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশেও প্রতিবছর প্রায় ১৮ হাজার নারী নতুন করে জরায়ুমুখ ক্যানসারে আক্রান্ত হন এবং প্রতিবছর প্রায় ১২ হাজার নারী এই ক্যানসারে মারা যান। জরায়ুমুখে মরণব্যাধি ক্যানসার কারও শরীরে বাসা বাঁধছে কি না, তা বের করা সম্ভব ‘প্যাপ টেস্ট’ নামের একটি পদ্ধতির মাধ্যমে।
‘প্যাপ টেস্টের’ মাধ্যমে জরায়ুমুখের কোষের পরিবর্তন নির্ণয় করা হয়। ব্রাশ অথবা স্পেকুলাম নামের সরঞ্জাম জরায়ুমুখে প্রবেশ করিয়ে জরায়ু থেকে কোষ সংগ্রহ করে তা পরীক্ষার জন্য ল্যাবরেটরিতে পাঠানো হয়। জরায়ুকোষে যেকোনো ধরনের পরিবর্তন ধরা পড়লেই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দ্রুত সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা শুরু করতে পারেন, যেন ভবিষ্যতে রোগীর ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা না থাকে।
যৌন সংস্পর্শ এই রোগ ছড়ানোর প্রধান কারণ। যৌন সক্রিয় প্রত্যেক নারীই তাই এই ঝুঁকির আওতাভুক্ত। যেকোনো নারীর দৈহিক সম্পর্ক শুরুর তিন বছর পর থেকে বছরে একবার ‘প্যাপ টেস্ট’ করা প্রয়োজন। যদি পর পর তিনটি পরীক্ষার ফলাফলে কোনো সমস্যা চিহ্নিত না হয়, সে ক্ষেত্রে প্রতি তিন বছরে একবার প্যাপ টেস্ট করা যেতে পারে। মেনোপজ অথবা জরায়ুর আংশিক অপসারণের পরও প্যাপ টেস্ট অব্যাহত রাখা দরকার। তবে ৭০ বছরের বেশি বয়স্ক নারীদের জন্য যদি বিগত ১০ বছরে পর পর তিনটি পরীক্ষার ফলাফলে কোনো সমস্যা না থাকে, তাহলে তাঁদের আর প্যাপ টেস্ট করার প্রয়োজন নেই। অন্তঃসত্ত্বা নারীদের ‘প্যাপ টেস্ট’ করা যেতে পারে। পিরিয়ডের সময়টুকু বাদ দিয়ে মাসের যেকোনো দিন আপনি প্যাপ টেস্টের জন্য বেছে নিতে পারেন। তবে পরীক্ষাটির অন্তত ২৪ ঘণ্টা আগে থেকে দৈহিক মিলনে বিরত থাকতে হবে।
মনে রাখবেন জরায়ুমুখের ক্যানসার কোনো ছোঁয়াচে রোগ নয়। হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস (এইচপিভি) নামের একটি ঘাতক ভাইরাস এই রোগের জন্য দায়ী। সাধারণত বেশির ভাগ জীবদ্দশায় একাধিকবার এইচপিভি ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হন। একজন নারীর সহজাত প্রতিরোধ ক্ষমতা বা কনডমের ব্যবহার কখনোই এই সংক্রমণের বিরুদ্ধে স্থায়ী প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করতে পারে না।
সম্প্রতি জরায়ুমুখ ক্যানসার প্রতিরোধে অতি কার্যকর টিকা আবিষ্কৃত হয়েছে। পর পর তিন ডোজ টিকা, নিয়মিত প্যাপ টেস্টের মাধ্যমে স্ত্রিনিং, চিকিৎসকের পরামর্শ এবং সাবধানতা জরায়ুমুখের ক্যানসর প্রায় পুরোপুরি প্রতিরোধ করতে পারে।
প্রশ্ন : স্ক্রিনিং কীভাবে করা হয়? কখন করা উচিত বলে মনে করেন?
উত্তর : তিন বছর যেকোনো নারীই যদি সেক্সুয়ালি অ্যাকটিভ থাকে, সেই এটি করবে। প্রতিবছর করতে পারে, সেটাই করা উচিত। তিন বছর পর পর তো করা উচিতই।
প্রশ্ন : জরায়ুমুখের ক্যানসারকে কেন বেশি প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে।
উত্তর : স্তন ক্যানসারের পরপরই নারীরা জরায়ুমুখের ক্যানসারে আক্রান্ত হয়। এটা বাইরের দিকে থাকে। সহজেই আমরা এর রোগটা নির্ণয় করতে পারি। এর একটি প্রাথমিক পর্যায়ও আছে। ক্যানসার হওয়ার অনেক আগেই এটি আমরা নির্ণয় করতে পারি। প্রাথমিক অবস্থায় এটি ধরা পড়লে প্রায় ৯৫ শতাংশ রোগী ভালো হয়ে যায়।
প্রশ্ন : প্রাথমিক পর্যায়ে কী কী ধরনের লক্ষণ প্রকাশ পায়?
উত্তর : এর একটি প্রি-ক্যানসারাস পর্যায় আছে। এটার কোনো উপসর্গ নাও থাকতে পারে। স্ক্রিনিং যে প্রোগ্রামগুলো আছে, এগুলোতে অনেক আগেই ধরতে পারি। প্রাথমিক পর্যায়ে চিকিৎসা নিলে সেটা ক্যানসারের দিকে যায়ই না। প্যাপসমেয়ার পরীক্ষা আছে, তিন বছর পর পর যদি কোনো নারী এটি করে, তাহলে হয়। এই স্ক্রিনিং প্রোগ্রামে যদি কেউ থাকে, ক্যানসারের পূর্বাবস্থায় যদি রোগটা ধরা যায়, তাহলে চিকিৎসা অনেক সহজ হবে।
আমাদের দেশ যেহেতু উন্নয়নশীল দেশ, এখানে লোকজনের স্বাস্থ্য সচেতনতা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, সেক্সুয়ালি ট্রান্সমিটেড রোগ, বাল্যবিবাহ, মাল্টিপল সেক্সুয়াল পার্টনার, এইচআইভি, ধূমপান, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকা।
আরেকটি হলো হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস দিয়ে হয়। হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাসের ৮০ শতাংশ ক্ষেত্রে সংক্রমণ পাওয়া যায়। এর একটি ভ্যাকসিন আছে। যদি এটি আমরা আগেই বাচ্চাদের দিয়ে দিতে পারি, সেক্সুয়ালি অ্যাকটিভ হওয়ার আগেই যদি ভ্যাকসিন দিয়ে দেওয়া যায়, তাহলে সেটি থেকে মুক্ত থাকা সম্ভব।
জরায়ুমুখের ক্যানসারের প্রাথমিক কিছু লক্ষণ
অনেক সময় প্রাথমিক পর্যায়ে লক্ষণ না প্রকাশ করেই জরায়ুমুখের ক্যানসার হতে পারে। আবার কখনো কখনো কিছু লক্ষণ প্রকাশ হতে পারে।
প্রশ্ন : প্রাথমিক পর্যায়ে কী কী ধরনের অভিযোগ নিয়ে রোগীরা আসে?
উত্তর : সাধারণত আমাদের কাছে যেটা আসে, অতিরিক্ত সাদা স্রাব, এটা ভাতের মাড়ের মতো হয়। ঋতুর সময় ছাড়া অনিয়মিত রক্তস্রাব, দুর্গন্ধযুক্ত রক্তস্রাব, এগুলো নিয়েই আমাদের কাছে প্রধানত আসে। আমরা যখন পরীক্ষা করি, তখন জরায়ুমুখে ক্ষত পাই, আলসার যাকে বলি। জরায়ুমুখের ওপর একটি আলাদা অংশ পাই। জরায়ুমুখ হয়তো ক্ষত-বিক্ষত থাকে। যদি হয়ে যায় তখন বায়োপসি করতে হয়।
প্রশ্ন : প্রাথমিক পর্যায় বলতে কী বোঝাতে চাইছেন?
উত্তর : প্রাথমিক অবস্থায় জরায়ুমুখের যে কোষগুলো থাকে, সেগুলোতে কিছু পরিবর্তন আসে। সেই পরিবর্তনগুলো প্রথম থেকে আমরা ধরতে পারি।
আমাদের জেলা পর্যায়েও কিন্তু কিছু কিছু টেস্ট হয়। ভায়া পরীক্ষা হয়। ভায়া পজিটিভ হলে জেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোতে আসে। এখানে কল্পোস্কোপি করা যায়। প্যাপসমেয়ার করা যায়। এগুলো প্রায় বিনামূল্যেই করা হয়। যে কেউ এটি করতে পারেন। কেবল সচেতনতা থাকলে জরায়ুমুখের ক্যানসার প্রতিরোধ করতে পারি।
No comments:
Post a Comment