গর্ভধার‌ণ বিষ‌য়ে গুরুত্বপূর্ণ ডাক্তা‌রি পরামর্শ

গর্ভাবস্থা শুরুর কত দিন আগে ডাক্তা‌রি পরামর্শ নিতে হবে, বা গর্ভধার‌ণের আ‌গে ও প‌রে করণীয় কি? এসব বিষয়ে এনটিভিতে কথা বলেছেন ডা. সায়লা পারভীন। বর্তমানে তিনি মহাখালী ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের গাইনি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত।

গর্ভধারণের কত দিন আগে পরামর্শ জরুরি?

একটি সুস্থ শিশু জন্ম দেওয়ার জন্য গর্ভাবস্থায় যেমন চিকিৎসকের পরামর্শ প্রয়োজন, তেমনি গর্ভধারণের আগেও পরামর্শ নেওয়া জরুরি।

প্রশ্ন : প্রি-প্রেগন্যান্সি কাউন্সেলিং (গর্ভ-পূর্ববর্তী পরামর্শ) বলতে কী বোঝানো হচ্ছে?
উত্তর : গর্ভধারণের অন্তত তিন মাস আগে সে চিকিৎসকের কাছে আসবে। তাকে আমরা কিছু উপদেশ দেবো, কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করব। তার কোনো অসুখ থাকলে সেগুলো নিয়ন্ত্রণে এনে তাকে গর্ভধারণ করতে বলব। কতগুলো টিকাও আমরা এর মধ্য দিয়ে দেবো, যেমন—টিটিনাসের টিকা, এমএমআর ভ্যাকসিন।
প্রশ্ন : গর্ভাবস্থার কত দিন আগে থেকে পরামর্শ জরুরি?
উত্তর : অন্তত তিন মাস আগে। ছয় মাস বা এক বছর আগে হলে আরো ভালো হয়। টিকা দেওয়ার বিষয় থাকে। ওজন যদি বেশি থাকে, সেটি সে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসবে। তার যদি কম ওজন থাকে, একে সে স্বাভাবিক করবে। তার যদি ডায়াবেটিস থাকে, উচ্চ রক্তচাপ থাকে, কিডনির রোগ থাকে, তাহলে এগুলোকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসে গর্ভধারণ করতে পারবে।

** গর্ভধারণের আগে মায়ের মানসিক সুস্থতা জরুরি

শিশুর বিকাশ ভালোভাবে হওয়ার জন্য মায়ের শারীরিক সুস্থতার পাশাপাশি মানসিক সুস্থতারও প্রয়োজন। আর সেটি প্রয়োজন গর্ভধারণের আগে থেকেই। এতে শিশুর বিকাশ ভালোভাবে হয়। একজন সুস্থ মা সুস্থ শিশু জন্ম দিতে পারেন।

প্রশ্ন : এ ক্ষেত্রে মানসিক সুস্থতার গুরুত্ব আপনাদের কাছে কতখানি?
উত্তর : মা যদি বিষণ্ণতায় ভোগেন এবং তাঁর যদি অন্য কোনো মানসিক সমস্যা থাকে, তাহলে পরে বাচ্চারও সমস্যা হয়। সে জন্যই বলা হয়, গর্ভধারণের আগে শারীরিক সুস্থতার পরামর্শের পাশাপাশি মানসিক সুস্থতার পরামর্শ নেওয়াও প্রয়োজন। অনেক সময় মেয়েরা বিষণ্ণতায় ভোগেন, নানা ধরনের সামাজিক অস্থিরতায় ভোগেন। মানসিক চিকিৎসা এখন খুব ভালো রয়েছে। যদি তার বিষণ্ণতা থাকে, তাহলে সাইকোথেরাপি দিয়ে তাকে সুস্থ করে নিলেই ভালো হয়। এরপর গর্ভধারণ করলে শিশুর বিকাশ ভালোভাবে হয়।

** গর্ভধারণের জন্য ঝুঁকিমুক্ত বয়স কত?

গর্ভধারণের জন্য সঠিক একটি বয়স রয়েছে। এর আগে বা এর পরে গর্ভধারণ করলে মা ও শিশুর বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা হতে পারে। অনেক সময় মৃত্যুর ঝুঁকি পর্যন্ত থেকে যায়। তাই জেনে নিন গর্ভধারণের উপযুক্ত বয়স সম্পর্কে।

প্রশ্ন : গর্ভধারণের ক্ষেত্রে প্রথমেই কোন জিনিসটিকে গুরুত্ব দিতে বলেন? বা পরামর্শ দেওয়ার ক্ষেত্রে কোন বিষয়টি আগে দেখেন?
উত্তর : প্রথমে আমরা দেখি বয়সটা কত। ১৮ থেকে ৩০-এর মধ্যে দিতে হবে। এর মধ্যেই উচিত পরিবার পূর্ণ করে ফেলা। দেখা যায়, মায়ের ঝুঁকি বেড়ে যায়, বাচ্চার অস্বাভাবিকতা অনেক বেড়ে যায়। ১৮ বছরের আগে হলে মায়ের মৃত্যুহার, শিশুর মৃত্যুর হার বেশি হয়। জটিলতাও বেশি হয়। বয়স এই ক্ষেত্রে বড় একটি বিষয় হিসেবে কাজ করে।
আবার অনেকে আছে যে বাচ্চা নিতেই চায় না। বলে ক্যারিয়ার তৈরি করব। ক্যারিয়ার তৈরি করতে গিয়ে দেখা যায় তার অস্বাভাবিক হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়। স্বাস্থ্যঝুঁকি বেড়ে যায়। দেখা যায়, তার ডায়াবেটিস হয়ে যাচ্ছে। অন্যান্য বিষয় রয়েছে।
প্রশ্ন : সবচেয়ে ঝুঁকিমুক্ত বয়স কত?
উত্তর : সবচেয়ে ঝুঁকি ছাড়া বয়স হলো ১৮ থেকে ৩০।

** গর্ভধারণের আগে পরামর্শ কেন জরুরি?

শুধু গর্ভাবস্থাতেই নয়, গর্ভধারণের আগেও পরামর্শ জরুরি। এতে মা ও শিশু উভয়েই ভালো থাকে এবং অনেক ধরনের অনভিপ্রেত ঘটনা থেকে সুরক্ষিত থাকা যায়। তবে আমাদের দেশে এই পরামর্শ নেওয়ার হার অনেক কম, যেটা বাড়ানো প্রয়োজন।

প্রশ্ন : এখন পর্যন্ত গর্ভধারণের আগে পরামর্শের প্র্যাকটিস আমাদের দেশে খুব বেশি নেই। গর্ভধারণের আগে পরামর্শের গুরুত্ব কতখানি?
উত্তর : গর্ভধারণের আগে পরামর্শের গুরুত্ব অনেক। যদি ডায়াবেটিস থাকে, যদি অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের কারণে সে বাচ্চা নেয়, তাহলে বড় বড় অস্বাভাবিকতা হতে পারে। তাই আগে থেকেই পরামর্শ নিতে হবে। মায়েরও অনেক সময় রক্তপাত বেশি হতে পারে। সে সময় সংক্রমণ হতে পারে। এরপর থাইরয়েডের সমস্যা হয়, হাইপো বা হাইপোথাইরয়েডের সমস্যা হয়, এটাও নিয়ন্ত্রণ করে নিলে দেখা যায় বাচ্চার কনজেনিটাল এনোমালি হয় না। অস্বাভাবিক সন্তান জন্ম নেয় না। এগুলো নির্ণয় করে চিকিৎসার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করে সন্তান জন্ম দিয়ে সুস্থ সন্তানের আশা করা যায়। আর তাই গর্ভধারণের আগে পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন। এ বিষয়ে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।

** গর্ভধারণের আগে যা করবেন

গর্ভধারণের আগে দৈনন্দিন জীবনে কিছু পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। কিছু নিয়ম মানা জরুরি।
প্রশ্ন : গর্ভধারণের আগে দৈনন্দিন জীবনযাপনে কোনো পরিবর্তন আনার জন্য কোনো উপদেশ দিয়ে থাকেন কি?
উত্তর : যেমন সে যদি ঘরে বসে থাকে, আমরা বলব, একটু ব্যায়াম করেন। এতে ফিটনেস বাড়বে। নিয়মিত সে এক ঘণ্টা হাঁটবে। ওজন যদি বেশি থাকে, তাকে কমাতে হবে।
আর যদি অ্যানিমিয়া (রক্তস্বল্পতা) থাকে, তাহলে তাকে আয়রন সাপ্লিমেন্ট দিই। যেসব খাবারে আয়রন রয়েছে, সেগুলো খেতে বলি। এতে আরো যেগুলো তার অসুখ রয়েছে, সেগুলো তার নিয়ন্ত্রণে থাকবে। অনেক সময় দেখা যায় অসুখ নেই, তবে পরিবারে যদি ডায়াবেটিস থাকে, তাহলে জেসটেশনাল ডায়াবেটিস হওয়ার অনেক আশঙ্কা থাকে। তাদের আমরা মিষ্টি জিনিস একটু কম খেতে বলি। সে ফলমূল খাবে, শাকসবজি প্রচুর খাবে। তবে মিষ্টিটা এড়িয়ে যাবে। যেহেতু পারিবারিক ইতিহাস আছে, তার কিন্তু জেসটেশনাল ডায়াবেটিস বা গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস হতে পারে।
আরো কিছু কনজেনিটাল রোগ রয়েছে। যেমন হিমোফেলিয়া থাকলে মা ক্যারিয়ার থাকে। তবে সেটি অবশ্য সে রকম বোঝা যায় না। আর যদি থ্যালাসেমিয়া দুজনেই ক্যারিয়ার হয়, তাহলে তাদের আমরা বলি বাচ্চা না নিলেই ভালো হয়। কারণ, দুজনেই যদি থাকে, তাহলে দেখা যায় বাচ্চার মেজর থ্যালাসেমিয়া হবে। আর নিলেও বোনমেরু ট্রান্সপ্ল্যান্ট করার কিছু সুযোগ থাকে। এরপর আরো কিছু কিছু বোনমেরু রোগ রয়েছে, এগুলোতে আমরা বলি যে না নেওয়াই ভালো।
গর্ভধারণের আগে পরামর্শের মাধ্যমে শিশু মৃত্যুহার আমরা অনেক কমিয়ে দিতে পারি। অস্বাভাবিক বাচ্চার হারও আমরা অনেক কমিয়ে দিতে পারি। পরিপূর্ণ সুস্থ থাকতে পারে। আর পোস্ট পার্টাম যে সমস্যাগুলো, সেগুলো আমরা শূন্যের কোঠায় নিয়ে আসতে পারি। এমনিতেই আমাদের দেশে শিশু মৃত্যুর হার এবং মাতৃমৃত্যুর হার এখনো অনেক বেশি হয়। সুতরাং এর প্রয়োজনীয়তা অনেক বেশি।
প্রশ্ন : এ ক্ষেত্রে পরিবারের কোনো ভূমিকা রয়েছে বলে কি আপনি মনে করেন?
উত্তর : কাউন্সেলিং তো স্বামীকেও করতে হবে। তার শাশুড়ি বা অন্যান্য যাঁরা রয়েছেন, তাঁদেরও করতে হবে। এ দেশে অনেকেরই যৌথ পরিবার থাকে, শাশুড়ি ও ননদদেরও এনে যে মায়ের যত্ন নিলে ভবিষতে তাঁদেরই একটি শিশু সুস্থ হবে, স্বাস্থ্যকর হবে। এতে মায়ের স্বাস্থ্যও ভালো হবে। মাও বাচ্চাকে সুস্থভাবে লালনপালন করতে পারবেন। স্বামীকেও কাউন্সেলিংয়ের সময় অবশ্যই উপস্থিত থাকতে হবে।

** গর্ভধারণের আগে নিয়ন্ত্রণ করুন ডায়াবেটিস

গর্ভধারণের আগে ডায়াবেটিস বা অন্যান্য রোগ থাকলে সেগুলো নিয়ন্ত্রণ করা খুব জরুরি। না হলে গর্ভাবস্থায় কিছু ঝুঁকি হতে পারে।
প্রশ্ন : অনেক অসুখ রয়েছে, যেগুলো গর্ভকালীন হওয়ার ঝুঁকি থাকে। আবার অনেকের আগে থাকেই ডায়াবেটিস থাকে। এদের ক্ষেত্রে আপনারা কি পরামর্শ দিয়ে থাকেন?
উত্তর : গর্ভধারণের আগে ডায়াবেটিস থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে তারা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করে নেবে। হিমোগ্লোবিন এওয়ানসি, ব্লাড সুগার ফাস্টিং এগুলো একদম নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসবে। ওজন বেশি থাকলে একে কমিয়ে নিয়ে এসে, বিশেষজ্ঞের মতামত নিয়ে এরপর সে গর্ভধারণ করবে। একটি ডায়েট চার্ট তাকে দিয়ে দেওয়া হবে।
প্রশ্ন : আপনারা কী রকম সাড়া পাচ্ছেন এ ক্ষেত্রে?
উত্তর : আমরা যদি ভালোভাবে বুঝিয়ে দিই, মায়েরা অবশ্যই শোনেন। মায়েরা বিষয়টিতে সাড়া দেওয়ার চেষ্টা করেন।

#Why do advices necessary for pre - pregnancy phase ?

No comments:

Post a Comment